পত্রিকা খুললেই দেখা যায় ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে হাজার হাজার ডলার আয়ের খবর। স্টুডেন্ট, চাকরীপ্রত্যাশী থেকে শুরু করে অনেক চাকরিজীবীও এসব খবর দেখে এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অনেকেই মনে করে একটা কম্পিউটার কিনে, ২-৩ মাস ট্রেনিং নিয়ে বসে পড়লেই হাজার-হাজার ডলার আয় করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা মোটেও এমন না। এমনকি পত্রিকায় যেটা বলা হয় সেটা যে শতভাগ সত্যি এমনও না।
অনলাইনে কাজ করে কিভাবে আয় করা যায় সে বিষয়ে সাহায্য করার জন্য বিগত কয়েক বছরে অনেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। আমি যখন জানতে চাইলাম তারা কম্পিউটার সম্পর্কে কতটুকু বোঝে তখন মোটামুটি এমন বক্তব্য পেলাম-
- যদি আয় করার সম্ভাবনা থাকে তাহলে কম্পিউটার কিনব।
- কম্পিউটারে টুকটাক টাইপিং করতে পারি।
- CPA মার্কেটিং এর কাজ করেছি।
- জিমেইল আইডি খোলার কাজ করেছি।
- মোবাইল দিয়েই আয় করা যায় না?
- আমি শুনেছি ক্লিক করে করে ডলার পাওয়া যায়।
- নেটে টাকা ঢুকালেই তো টাকা আসে শুনেছি। … ইত্যাদি।
আমি তাদেরকে যখন বিস্তারিত বুঝিয়ে বললাম যে, অনেক ধরণের কাজ আছে যেমন-
- কম্পিউটার গ্রাফিকস
- সফটওয়্যার টেস্টিং
- অ্যানিমেশন
- ডিজিটাল মার্কেটিং
- সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং
- সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন
- অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং
- সাইবার সিকিউরিটি
- অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট
- ওয়েব ডেভেলপমেন্ট …ইত্যাদি
এর মধ্যে আপনাকে প্রথমত যেকোনো একটি বা একাধিক কাজে মোটামুটি দক্ষতা অর্জন করতে হবে, সময় দিতে হবে এর জন্য কতদিন সময় লাগবে সেটা নির্ভর করছে আইটি বিষয়ে আপনার কতটুকু অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, ধারণা, আগ্রহ এবং লেগে থাকার ইচ্ছা আছে তার উপর। কাজ শিখে অন্যের কাজ করে দেওয়ার মতো দক্ষতা অর্জনের পরই কেবল এখান থেকে আয় করার চিন্তা করা যায়। এরপরও নিশ্চিত আয় করতে পারবেন এমন কোনো গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না।
অনলাইনে কাজ করে আয় করার ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা শুধুমাত্র তারই বেশি যে টাকা উপার্জনের চিন্তা বাদ দিয়ে আগে কাজ শেখার এবং দক্ষতা অর্জনের দিকে মনোযোগী হয়, এমনকি যদি তার জন্য ৫ বছরও সময় লাগে।
এসব কথাগুলো শোনার পর তারা পুরোই হতাশ হয়ে যায়। কারন, তারা অনেক জায়গায় দেখেছে অনলাইনে খুব সহজেই আয় করা যায়। সবাই চায় খুব সহজে কম কাজ করে কিংবা কাজ না করেই টাকা উপার্জন করতে। কিন্তু এতো কষ্ট করতে হবে জানার পর তার সেই আগ্রহ ওখানেই শেষ হয়ে যায়।
কোর্স করলে প্রথম মাস থেকেই আয়
অনেকে বলে ইউটিউবে দেখেছে ৩-৬ মাসের কোর্স করলে প্রথম মাস থেকেই ২০-৩০ হাজার টাকা আয় হবে গ্যারান্টি দিয়ে কোর্স করানো হচ্ছে। এগুলোর ব্যাপার কি?
সত্যি বলতে এগুলোর বিষয়ে আমি নিজেও ভালোমতো জানি না, জানার চেষ্টাও করি না। তবে যতটুকু বুঝি, এরা তেমন ভালো কিছু শেখায় না। শেখাবেই বা কি? নিজেরা ভালো কিছু পারলে তারপরই তো শেখাবে! এরা অনেক টাকা নিয়ে কোর্স করায় আর কিছু কৌশলে ফেক আয় দেখায় এবং টাকা পাইয়ে দেয়। কারো কাছ থেকে ৩০-৫০ হাজার টাকা নিলাম আর মাঝে তাকে ১০-১৫ হাজার টাকা পাইয়ে দিলাম, ব্যাস! তাদের দেখাদেখি আরও অনেকে মিথ্যা আয়ের প্রলোভনে পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। টার্গেট দেশের চাকরিপ্রাথী বেকার জনগোষ্ঠী। অথচ দেশে অনেক নামকরা প্রশিক্ষকও আছে। তারা কখনোই এমন গ্যারান্টি দেয় না।
স্টুডেন্টদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং কতটা উপযোগী?
ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের একটা বড় অংশই স্টুডেন্ট অথবা স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছেন। প্রায়ই খবরে দেখবেন, দশম শ্রেণির ছাত্র হাজার ডলার আয় করছে ঘরে বসে।
প্রকৃতপক্ষে স্টুডেন্ট থাকা অবস্থাতেই ফ্রিল্যান্সিং করা বা কাজ শেখার উপযুক্ত পরিবেশ থাকে। বাংলাদেশে এমন অনেক সফল ব্যক্তিকে আপনি পাবেন যারা পড়াশোনা শেষে ফুল-টাইম ফ্রিল্যান্সার হয়ে গিয়েছেন, আইটি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন অথবা কোনো আইটি কোম্পানিতে জব করছেন, যদিও তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এটা সম্ভব হয়েছ আইটি বিষয়ে তাদের ভালো দক্ষতা থাকার কারনে। যেটা তারা অর্জন করেছেন স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায়।
তবে সবার ক্ষেত্রে তেমন পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা নাও থাকতে পারে। পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য কাজে মনোযোগ দিলে পড়াশোনার ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। তাই স্টুডেন্টদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং কতটা উপযোগী -এটার পক্ষে-বিপক্ষে দু-দিকেই যুক্তি আছে।
চাকরিজীবীরা কি ফ্রিল্যান্সিং করতে পারে?
অনেকে বলেন, আমি তো একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। সপ্তাহে দুই দিন ছুটি থাকে আবার প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আর কোনো কাজ থাকে না। তাহলে আমি প্রতিদিন যদি ২-৩ ঘন্টা সময় দেই তাহলে এখান থেকে আয় করা সম্ভব কিনা?
চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করা আসলেই সম্ভব কিনা আপনিই নিজেই বুঝতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, এটাও এক প্রকার চাকরি। এখানে কয়েকটা বিষয় বিবেচনা করতে হবে, যেমন-
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২-৩ ঘন্টা ঘড়ি ধরে কাজ সুযোগ নেই।
- অফিসের কাজ শেষে অবসর সময়টা আপনি বিশ্রাম এবং পরিবারের পেছনে না দিয়ে কাজ করবেন কিনা।
- আপনাকে সময়মতো এবং দ্রুত কাজ করে দিতে হবে, প্রেসার থাকবে। নতুবা আপনি কাজই পাবেন না।
- ছুটির দিনে আপনি ছুটি না কাটিয়ে, পরিবারকে সময় না দিয়ে এমন অতিরিক্ত প্রেসার নিতে পারবেন কিনা।
- ফ্রিল্যান্সিং করা যাবে এমন কোনো কাজে ইতোমধ্যে আপনার পর্যাপ্ত দক্ষতা আছে কিনা।
- দক্ষতা না থাকলে, সেটা অর্জনের পেছনে লম্বা সময় দিতে পারবেন কিনা।
এখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। বাংলাদেশে এমনও কেউ কেউ আছে যারা ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য চাকরি ছেড়েছেন। দুই দিকে সময় ব্যালেন্স করতে পারেননি এবং ফ্রিল্যান্সিং-এ সম্ভাবনা ভালো মনে হয়েছে বলেই তারা এমন করেছেন।
শেষ কথা হলো, পত্রিকা আর তথাকথিত কোর্স ব্যবসায়ীদের হাজার-হাজার ডলার আয়ের প্রলোভনে পড়লে শুধু ক্ষতিই হবে। পুরো বিষয়টা ভালোভাবে জেনে-বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কার জন্য কোনটা উপযোগী সেটা ঠিক করতে হবে। কাজ দেওয়ার নাম করে টাকা চাইলে তার থেকে তো আগেই দূরে থাকতে হবে। নয়তো এটা শুধুমাত্র সময় এবং অর্থের অপচয়ের কারন হবে।